কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন ভ্রমণ অভিজ্ঞতা

আমার জেলা কুড়িগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দুরত্ব প্রায় ৭৩০ কিলোমিটার। আর যদি টেকনাফের হিসেব করি তবে তা বেড়ে দাড়ায় ৮১০ কিলোমিটারের মত। কুড়িগ্রাম থেকে সরাসরি যাওয়ার উপায় নেই, যেতে হবে ভেঙ্গে ভেঙ্গে! একবার ভাবলাম ঢাকায় গিয়ে তারপর সেখান থেকে কক্সবাজার যাব তবে তাতে সময় অতিরিক্ত লাগায় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলাম। এখন আমাদের যাত্রা পরিকল্পনা হচ্ছে কুড়িগ্রাম থেকে চট্টগ্রাম, তারপর সেখান থেকে কক্সবাজার। হানিফ বাসে টিকিট কেটে নিলাম। এছাড়াও পরিকল্পনামাফিক টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনগামী জাহাজ কেয়ারি সিন্দাবাদের টিকিট কেটে নিলাম অনলাইনে। ওপেন ডেকে টিকেট কাটবেন তাহলে যাত্রাকালীন ভাল ভিউ পাবেন। চাইলে রিটার্ন টিকেটও কেটে রাখতে পারেন।

কক্সবাজারের সুর্যাস্ত
কক্সবাজারের সুর্যাস্ত

পরিকল্পনা করার সময় আমাদের সাথে যাবার কথা ছিল প্রায় ১০ জনের মত, তবে শেষমেশ ৩ জন! আমি, আমার বন্ধু রাকিব এবং মেহেদী ভাইকে নিয়ে আমাদের  যাত্রা শুধু হয়  আমাদের বিকেল ৫ টায়। এই সময়টাতে অন্য রুটের গাড়ি চলাচল না করায় খুব একটা জ্যাম দেখা যায়না। এর মাঝে কয়েকটা ছোট যাত্রাবিরতি দেয়া হয়, কুমিল্লায় একটু বেশীক্ষণ দাঁড়ানো হয়েছিল বাসের চাকায় একটু সমস্যা থাকায়। যাহোক আল্লাহ্‌ রহমতে কোনরূপ সমস্যা ছাড়াই সকাল ৭ টার কিছু পরে বন্দরনগরী নামে খ্যাত চট্টগ্রামে পৌছাই আমরা। সেখানে ফ্রেশ হয়ে আগে নাস্তার পর্বটি সেরে নিয়ে কক্সবাজারের বাস খুঁজতে লাগলাম। একটু পর পেয়েও গেলাম। চট্টগ্রাম শহরটা কেন জানি আমি বেশ ভাল লেগেছে।  পাহাড়, সমুদ্র, উপত্যকা, বন-বনানীর কারণে চট্টগ্রাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যতম লীলাভূমি। ইচ্ছে হচ্ছিল এখানেই দু’একদিন থেকে যাই! আজ হচ্ছেনা তবে খুব ইচ্ছে আছে ইনশাআল্লাহ্‌ শুধুমাত্র চট্টগ্রাম ঘুরতেই হয়তো আসবো একবার!

সুগন্ধা সী-বীচ
সুগন্ধা সী-বীচ

দুপুরের মাঝে প্রায় ৭৩০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে কক্সবাজারে পৌছে যাই। বাস থেকে নামলেই দেখবেন অনেক রিক্সাওয়ালা আপনাকে হোটেলে নিয়ে যেতে চাইবে। তারা সম্ভবত কিছু কমিশন পায় এই কাজ করে। উত্তম হচ্ছে ডলফিন মোড় থেকে কিছুদুর সামনে গিয়ে নিজেই দরদাম করে পছন্দমত রুম নেয়া। ছুটির দিনগুলোতে চাপ বেশী থাকায় অতিরিক্ত হোটেল ভাড়া গুণতে হয়। এক্ষেত্রে আমার পরামর্শ হচ্ছে আপনি যদি সম্ভব হয় তবে ছুটির দিন পরিহার করুন। এক্ষেত্রে ভাড়া বাচানোর পাশাপাশি ভিড় এড়িয়ে জায়গাগুলো বেশ সুন্দরভাবে ঘুরতে পারবেন।

রাতের পরিবেশে সমুদ্র দর্শন
রাতের পরিবেশে সমুদ্র দর্শন

যাহোক আমরা অনেক খোঁজাখুঁজির পর সৈকত আবাসিক রিসোর্ট নামের এক হোটেলে মোটামুটি মানের একটি রুম নেই। ফ্রেশ হয়ে গোসলের উদ্দেশ্যে রওনা হই সুগন্ধা সী-বীচ ভিউ পয়েন্টে। এর ফাকে অবশ্য দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়েছিলাম। প্রথম সমুদ্র দেখা!! বুঝতে পারছেন কেমন লাগার কথা! ”ওয়ান্স ইন এ লাইফ টাইম এক্সপেরিয়েন্স” বলতে যা বুঝায় আর কি! পাহাড় আমার প্রিয় তবে সমুদ্রের বিশালতার কাছেও যে অনেক কিছু শেখার আছে  সেদিন কিছুটা হলেও বুঝেছি। গোসল এবং দাপাদাপি শেষ যেন হয়ই নাহ আমাদের। বেশ উত্তেজনায় ডুব দিতে গিয়ে আমার আলিএক্সপ্রেসে অর্ডার করা সানগ্লাসটা ভেসে যায় আর সাথে বোনাস হিসেবে একটু পানি খেয়ে ফেলছিলাম। সমুদ্রের পানি যে আসলেই লবণাক্ত সেটা পরীক্ষাও হয়ে গেলো আর কি।হেহে।

ছবিটা আমার অনেক প্রিয়!
ছবিটা আমার অনেক প্রিয়!

হোটেলে এসে পোশাক পরিবর্তন করে আশেপাশে ঘুরাঘুরি করি কিচ্ছুক্ষণ। তারপর আবারো চলে যাই সমুদ্রতীরে। ততক্ষণে সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত হয়ে গেছে। রাতের বেলায় সাগরের গর্জন, চাঁদের আলো, মৃদু হাওয়া সবমিলিয়ে অসাধারণ একটা পরিস্থিতি! ঠিক এই সময়েই মেহেদী ভাইয়ের ফোনে একটা মেসেজ এসেছে যে তার প্রাইমারী চাকুরীটা হয়ে গেছে! তিনি তো আনন্দে আত্মহারা, সাথে খুশি আমরাও। ভাই নিজ দায়িত্ব আমাদের ট্রিট দিয়েছেন অবশ্য। 😀

মেহেদী ভাইয়ের ট্রিট
মেহেদী ভাইয়ের চাকুরীর  ট্রিট

পরদিন উদ্দেশ্য হচ্ছে মহেশখালী। সময়মত ঘুম থেকে উঠে হাল্কা নাস্তা সেরেই রওনা দেই রিক্সা চেপে। ৬নং জেটি (ঘাট) এ আসার পর স্পিডবোট ভাড়া নিয়ে যাত্রা শুরু করে দেই আমাদের গন্তব্যের দিকে। বৌদ্ধ সেন মহেশ্বর থেকে এই জায়গার নামকরণ করা হয়। এখানে মৈনাক পর্বতের উপর আছে আদিনাথ মন্দির। আরো আছে স্বর্ণ মন্দিরসহ আমার নাম না জানা বেশ কয়েকটি মন্দির। মহেশখালীতে এসে রিক্সা নেন আর যাই নেন, একটু দর কষাকষি করবেন অবশ্যই। বেশ বাড়িয়ে দাম চায়। আর আমার কাছে আদিনাথ মন্দিরটাই দেখার মত লেগেছে। বাকিগুলোও খারাপ নাহ যদিও।

মেহশখালী
মহেশখালী 

মহেশখালী ঘুরে কক্সবাজারে এসে বীচে গিয়ে আরেকটু ঢু মেরে সামুদ্রিক মাছ আর রাতের খাবার সেরে পরের দিনের পরিকল্পনা করি। পরদিন সকালে উঠেই সিএনজিতে চেপে রওনা দেই টেকনাফের উদ্দেশ্যে। সেন্ট মার্টিনের জাহাজ ছাড়বে ঠিক ৯ঃ৩০ মিনিটে তাই  খুব সকালেই যাত্রা শুরু করতে হয়। মেরিন ড্রাইভের এক দিকে সাগর অন্যদিকে পাহাড়, এমন সব অসাধারণ দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা পৌছে যাই টেকনাফ। সেখানে নাস্তা সেরে জাহাজে উঠে যাই। অনলাইনে টিকেট কাটা থাকায় ঝামেলা পোহাতে হয়নি।

নাফ নদী, আমি ও গাঙচিল
নাফ নদী, আমি ও গাঙচিল

জাহাজ ছাড়ার পর গাঙ্গচিলগুলো উড়ে আসার দৃশ্য সত্যিই অনেক বেশীই ভাল লাগায়। চিপস ছুড়ে দিলে একটাও মিস করেনা তারা। হাহা। নাফ নদী, তার ওপারে মিয়ানমার সীমান্তের সৌন্দর্য এবং বঙ্গোপসাগরের জলরাশি তথা বিশালতা দেখতে দেখতে পৌছে যাই  সেন্টমার্টিন। ভিড় বেশী থাকায় হোটেলের ভাড়াও বেশ চড়া! যাহোক একটি রুম ঠিক করলাম আর ফ্রেশ হয়ে বাইরে আসলাম ঘুরতে।দুপুরের খাবার শেষ করে সাইকেল ভাড়া নিয়ে রওনা দিলাম ছেড়াদ্বীপের উদ্দেশ্যে। ইঞ্জিনচালিত নৌকায় যাওয়া যায় তবে আমাদের কাছে সাইকেলে যাওয়াটাই উত্তম মনে হয়েছিল। সাগরের পাশে সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে পৌছে গেলাম ছেড়াদ্বীপে। সেন্টমার্টিন পুরো যায়গাটাই অস্বাভাবিক রকমের সুন্দর আর ছেড়াদ্বীপে সেই সৌন্দর্য বোধহয় ঈষৎ পরিমাণে হলেও কিছুটা বেশী। কিছুক্ষণ সেখানে ঘুরাঘুরি এবং বিশ্রাম নিয়ে ফিরে আসলাম সেখান থেকে।

প্রবাল দ্বীপে আমি :P
প্রবাল দ্বীপে প্রবাল ও আমি 😛

ফিরে এসে একটু বিশ্রাম নিয়ে গেলাম হুমায়ুন আহমেদের বাড়ি সমুদ্রবিলাস দেখতে। এরপর সমুদ্রের পাড়ে বসে শুয়ে রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলাম। সমুদ্রের গর্জনের মাঝেও কেমন যেন একটা নীরবতা আছে বলে আমার মনে হয়। এটা বেশ উপভোগ্য বটে! এরপর রাতের খাবার খেয়ে ফিরে এলাম হোটেলে।

ছেড়াদ্বীপ
ছেড়াদ্বীপ

পরদিন সকালে একটু বৃষ্টি হওয়ায় ঘুমটা একটু বেশীই হয়েছে। একটু দেরীতে উঠে সিদ্ধান্ত নিলাম হেটে বেড়াব পুরো সেন্টমার্টিন। সাগরের পাড়ে হাটতে হাটতে মোটামুটি পুরো সেন্টমার্টিন শেষই করে ফেলছি বলা যায়। আগের দিন সাইকেল চালিয়ে অর্ধেক তো শেষ করেছিলাম, আজ বাকি অর্ধেক। এমনিতে খুব বেশী বড় না আসলে এই একমাত্র প্রবাল দ্বীপটি। ঘড়িতে তখন সম্ভবত ১১ টা ছুই ছুই, আমাদের জাহাজ ধরতে হবে ৩ টায়। তার আগে গোসল/খাওয়ার পর্বও তো শেষ করতে হবে! হোটেলে ফিরে ব্যাগ গুছিয়ে বেশ খুশিমনে এবং অনেকখানি স্মৃতি নিয়ে সেন্টমার্টিনকে বিদায় জানালাম। জাহাজ টেকনাফে এসে পৌছালো ৬ টার পরেই। এরপর বাসে চেপে ঢাকায় আসতে ভোর হয়ে গেল।

সেন্টমার্টিনের সৌন্দর্য
সেন্টমার্টিনের সৌন্দর্য

ঢাকায় এসে নাস্তার পর্ব সেরে সোজা গেলাম কমলাপুর রেল স্টেশন। কুড়িগ্রামগামী ট্রেনের টিকিট কেটে নিলাম। এবার ফেরার পালা! প্রথম সমুদ্রভ্রমণের অনেকগুলো সুখস্মৃতি নিয়ে  রাতে পৌছালাম প্রিয় জেলা কুড়িগ্রামে।

রংপুর এক্সপ্রেসে চেপে বাড়ি ফেরা
রংপুর এক্সপ্রেসে চেপে বাড়ি ফেরা

ডিসেম্বর ২৩, ২০১৯

Share This Article

2-removebg-preview

About Touhid

Hey! My full name is S M Touhidul Islam, a marketing professional and tech enthusiast from Bangladesh.

Share This Article