বর্তমান সমাজে অনেকেই মনে করেন যে, শুধু ইন্টারনেট থেকে আয় করাকেই হয়তো বলে ফ্রিল্যান্সিং। ফ্রিল্যান্সিং শব্দের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে মুক্তপেশা। মুলত ইন্টারনেটভিত্তিক যারা প্রজেক্ট ভিত্তিক কাজ করেন তাদের ফ্রিল্যান্সার হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। আপনি অনলাইনে হোক বা অফলাইন যেখানে কাজ করুন না কেন, দক্ষতা অর্জন ব্যাতীত কেউ আপনাকে টাকা দিবেনা। একজন রাজমিস্ত্রির কথাই ধরা যাক, তার দক্ষতা হচ্ছে তিনি বাড়ি বানাতে পারেন। এই দক্ষতা দিয়েই তিনি কাজ করেন এবং দিনশেষে আপনি তাকে টাকা দেন তার বিনিময়ে।
ইন্টারনেটে কাজগুলোর ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। প্রথমত আপনাকে মার্কেটেবল একটা স্কিল অর্জন করতে হবে। যেটা হতে পারে গ্রাফিক ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিং বা ওয়েবসাইট ডিজাইন। প্রতিটি ক্যাটাগরিতেই প্রচুর শাখা রয়েছে। ধরেন ডিজিটাল মার্কেটিং এ রয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং, সার্চ ইঞ্জিন অপ্টিমাইজেশন, কন্টেন্ট মার্কেটিং। আবার এসব সাব-ক্যাটেগরির ভিতরেও অনেক শাখা প্রশাখা রয়েছেঃ এসইও এর ভিতরেও রয়েছে অন-পেইজ এসইও/অফ পেইজ এসইও।
আপনি একজন রাজমিস্ত্রি বা রং মিস্ত্রিকে যেমন পারিশ্রমিক দেন, ঠিক একই পারিশ্রমিক কি তার সাহায্যকারী কর্মীকে দেন? উত্তর হচ্ছে না। ইন্টারনেট ভিত্তিক কাজেও তেমনি কাজের ধরন অনুযায়ী পারিশ্রমিক নির্ধারণ করা হয়। অফলাইনের কাজের তুলনায় অনলাইনভিত্তিক কাজে প্রতিদ্বন্দ্বী অনেক বেশী থাকে। কারণ খুব স্বাভাবিকভাবেই আপনি বিশ্বব্যাপী সকলের সাথে প্রতিযোগিতা করেই কাজ নিচ্ছেন। গ্লোবালি কাজ করছেন বিধায় পারিশ্রমিকটাও দেশের তুলনায় অনেকাংশে বেশী।
ফ্রিল্যান্সিং করতে কি লাগে এবং এটি আসলে কাদের জন্য?
মুলত ইন্টারনেট ভিত্তিক একটি কাজে দক্ষ হয়ে আপনার সেই অর্জিত দক্ষতা এবং শ্রম বিক্রয় করে আয় করার প্রসেসকেই আমরা মুলত ইন্টারনেটে ফ্রিল্যান্সিং বুঝাই। এক্ষেত্রে ফ্রিল্যান্সার না বলে আপনার পরিচয় মুলত গ্রাফিক ডিজাইনার বা ডিজিটার মার্কেটার কিংবা ওয়েব ডেভেলপার। এটা ব্যার্থদের যায়গা মনে করেন অনেকে! বাকি সব সেক্টরে ব্যার্থ এবং হতাশ হয়ে ফ্রিল্যান্সিং করতে আসেন এবং লোকের সংখ্যা নেহাতই কম না। কেউ বা আসেন শখ করে! কোনটাতেই আসলেই সমস্যা নাই, যেকেউ আসতে পারেন এই সেক্টরে কিন্তু কয়েকটি পুর্বশর্ত রয়েছেঃ
- সময়ঃ ১৫ বছর+ পড়াশুনা করে বেশ কয়েকটি ডিগ্রী নিয়ে আমরা ১৫ হাজার টাকার চাকুরী যোগাতে হিমশিম খেয়ে যাই। তাহলে এখানে এসে এত তাড়াহুড়া কেন শুরু হয়ে যায় আপনাদের আমি বুঝিনা! যদি এটাকে প্রফেশন হিসেবে নিতে চান তবে অবশ্যই যথেষ্ট সময় নিয়ে আসা উচিৎ। অন্তত কয়েক বছর সময় ব্যায় করার মানুষিকতা যদি না থাকে তবে আমি বলব এটা আপনার জন্য নয়!
- ইংরেজিঃ খুব স্বাভাবিকভাবেই কমিউনিকেশন স্কিলটা ভাল হওয়া বাঞ্চনীয় এখানে। ক্লায়েন্ট এর সাথে কথা বার্তা থেকে শুরু করে প্রতিটা পদক্ষেপেই ইংরেজি লাগবেই এখানে। কিছু কিছু সেক্টরে যেমন গ্রাফিক্স/ওয়েব ডিজাইন ইত্যাদিতে ইংরেজির ব্যবহার তুলনামুলক কম, তাই এসব কাজ করতে খুব একটা ইংরেজির ভাষার দক্ষতা প্রয়োজন নেই। তবে ক্লায়েন্টের সাথে কথা বলতে/কাজ বুঝাতে সাধারণ ইংরেজি বুঝতে এবং লিখতে পারাটা আবশ্যক। অন্যদিকে, কন্টেন্ট রাইটিং/সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন ইত্যাদি কাজের ক্ষেত্রে ইংরেজি বেশ প্রয়োজন। সুতরাং, এসব কাজ করতে গেলে ইংরেজি ভালভাবে শিখাটা আপনার জন্য আবশ্যক!
- স্কিল/দক্ষতাঃ সবথেকে গুরুত্বপুর্ন হচ্ছে এটি। আপনি দক্ষতা ব্যাতীত এই সেক্টরে ভাল কিছু করতে পারবেন না। কোন কাজটি ভাল লাগে এবং প্যাশন আছে সেটি নির্বাচন করা উচিৎ। Fiverr বা Upwork মার্কেটিপ্লেসগুলো ভিজিট করুন এবং ক্যাটাগরি/সাব-ক্যাটাগরি গুলো লক্ষ্য করুন। Graphics/Digital Marketing/Video editing/Programming সহ অনেক ক্যাটাগরি রয়েছে এবং প্রতিটা ক্যাটাগরিতে প্রচুর সাব-ক্যাটাগরি রয়েছে। মার্কেটপ্লেসগুলোতে মানুষ কি ধরণের সার্ভিস দিয়ে আয় করতে তা লক্ষ্য করতে পারেন। এবং সেই টপিক গুলো নিয়ে গুগল/ইউটিউবের ফ্রি রিসার্চ করে একটা প্রাথমিক ধারণা নিতে পারবেন। স্মার্ট এনাফ হলে অনেক কিছু বুঝে যাওয়ার কথা ইতিমধ্যেই। যে কাজ করতে ইন্টারেস্ট ফিল করবেন সেটি শেখা শুরু করে দিতে পারেন।
- মার্কেটপ্লেস সম্পর্কে ধারণাঃ কাজ শেখার পর সার্ভিস দিতে হবে আপনাকে মুলত মার্কেটপ্লেসে। Fiverr/upwork/freelancer এদের মাঝে যেটা ভাল লাগে সেখানেই আপনার সার্ভিস দেয়া শুরু করতে পারেন। আমার কাছে Fiverr বেশ ভাল লাগে, নতুনদের জন্য এটি সর্বোত্তম বলে আমার মনে হয়। যেখানেই সার্ভিস দেন না কেন, সেখানকার পদ্ধতি সম্পর্কে আগে ধারণা নেয়া উচিৎ। এক্ষেত্রে শর্ট কাট মাধ্যম হচ্ছে উক্ত ওয়েবসাইটে আপনি কি সার্ভিস দিবেন সেটা সার্চ করা, এক্সিস্টিং ফ্রিল্যান্সাররা যেভাবে তাদের সার্ভিস গিগ সাজিয়েছে তা থেকে ইনস্পায়ার হয়ে নিজস্বভাবে আপনি নিজেকে উপস্থাপন করতে পারেন। আমি যেসব মার্কেটপ্লেসে কাজ করি তা নিয়ে আরো বিস্তারিত হয়তো লিখব সামনে। আপাতত এই ব্যাসিক ধারণাটুকু দিলাম।
- ফ্রিল্যান্সিং শুরু করার ধাপ সমূহ সংক্ষেপেঃ সেক্টর সিলেক্ট করতে হবে/সেই কাজ গুলো ইতিমধ্যে যারা সার্ভিস দিচ্ছে সেটা যাচাই করবেন তাহলে একটা ধারণা পাবেন। তারপর সেই সব টপিক গুলো নিয়ে ইউটিউবে ভিডিও দেখে বেসিক ধারণা নিবেন এবং অনুশীলন করবেন। রিলেটেড ফেইসবুক গ্রুপগুলোতে আপডেটেড থাকার ট্রাই করলে অনেক কিছু জানতে পারবেন। আর অবশ্যই ছোট খাটো ইনফরমেশন কালেক্ট করার জন্য গুগল সার্চ করার অভ্যাস গড়ে তোলা। ইংরেজী যেহেতু বেশ দরকারী তাই এটিও রপ্ত করে ফেলতে হবে স্কিল শেখার পাশাপাশি। আর কাজ করার সাথে সাথে স্কিল আরো ডেভেলপ করতে হবে কারণ মার্কেট অনেক কম্পিটিটিভ। কম্পিউটার বা ল্যাপটপ থাকাটা কিন্তু বাঞ্চনীয়। ফোন দিয়ে ফ্রিল্যান্সিং সম্ভব নাহ। প্রচুর ধৈর্য ও আগ্রহ নিয়ে চললে সফলতা আসবে ইনশাআল্লাহ।
- নতুনদের জন্য কিছু উপদেশঃ প্রথম অবস্থাতে কাজের দক্ষতা খুব স্বাভাবিকভাবেই কম থাকবে এবং কাজ পেতে সময় লাগবে। কারণ আপনাকে কম্পিট করতে হবে অপেক্ষাকৃত রেপুটেড ফ্রিল্যান্সারদের সাথে। ভাল ফিডব্যাক থাকবে তাদের প্রফাইলে, অপরদিকে আপনার প্রফাইল থাকবে ফিডব্যাক শুণ্য! ক্লায়েন্ট আপনাকে সিলেক্ট করবে এই জন্য যথেষ্ট ইফোর্ট দিতে হবে আপনাকে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে এবং অসাধারণ কমিউনিকেশন স্কিলের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে আপনি কেন যোগ্য এই কাজের জন্য। ওয়ার্ক স্যাম্পল/পোর্টফোলিও বানানো একটি ভাল দিক হতে পারে এক্ষেত্রে। কাজের ধরণ অনুযায়ী Dribble/Behance/Github/Flickr ইত্যাদি ওয়েবসাইটে আপনার কাজগুলো পোর্টফোলিও হিসেবে আপলোড করে রাখতে পারেন। যদি নিজস্ব একটি পোর্টফোলিও ওয়েবসাইট থাকে তবে সেটি বেস্ট হবে!! আর কাজ না শিখে কোনভাবেই মার্কেটপ্লেসে আসবেন না। আপনার প্রথম উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ স্কিল্ড হওয়া। এটি মাথায় রাখতে হবে। শুভকামনা সবার জন্য।
No related posts.