প্রথম দিনঃ আমাদের বাইক ট্যুর শুরু হয় কুড়িগ্রাম থেকে। খুব সকালে উঠে হাল্কা নাস্তা করেই রওনা দেই মোগলবাসা ঘাটের উদ্দেশ্যে। নৌকা ৯টার দিক ছাড়ার কথা থাকলেও কোন কারণে ১০ টা বেজে যায়। মোগলবাসা ঘাট থেকে নৌকাযোগে রৌমারিতে পৌছাই প্রায় ১ টায়। এরপর রৌমারী থেকে শেরপুর – জামালপুর হয়েই যেতে হয় মুলত। আর এই অঞ্চলেই রয়েছে টুরিস্ট স্পট লাউচাপড়া, মধুটিলা এবং গজনী। এখন আবার নতুন সংযোজন হয়েছে তাওয়াকুচা মায়াবী লেক! মায়াবী লেক ব্যাতীত বাকি সব যায়গাই আগে এসেছিলাম আমরা। সেহেতু তেমন কোন বিরতি ছাড়াই আমরা এসব স্পট পার হয়ে ময়মনসিংহের দিকে রওনা হই।
রৌমারি থেকে শেরপুরের রাস্তা খুব একটা ভাল বলা যাবেনা তাই বাইক স্মুথলি চালানো যাচ্ছিলোনা। তবে শেরপুরের পরের রাস্তাগুলো অসাধারণ! রাত হয়ে যাওয়ায় আমরা সেদিনের মত ময়ময়সিংহ শহরের নিরালা রেস্ট হাউজে উঠি। হোটেল নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমরা বাইক পার্কিং এবং সিকিউরিটিকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি। খুব দেরী না করে পার্শ্ববর্তী একটি হোটেলে খাওয়া দাওয়া করে ঘুমায় যাই।
দ্বিতীয় দিনঃ খুব ভোরে উঠেই দেখি বৃষ্টি হচ্ছে! মন্থর গতিতে যাত্রা শুরু করে দেই। কিছুটা দেরি হলেও ধীর-স্থিরভাবেই নেত্রকোণা পৌছে যাই। সেখানে নির্মানাধীন শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটু ঢু মেরে সুনামগঞ্জের দিকে যেতে থাকি। সিলেট যাওয়ার রাস্তা মুলত দুটি। একটি সরাসরি সিলেট অন্যটি সুনামগঞ্জ হয়ে। ১০০ কিলো কম দুরত্ব দেখে আমরা সুনামগঞ্জের ম্যাপে অনুরসরণ করে। আমরা গুগল ম্যাপ দেখে আগাতে থাকি তবে বিপত্তি বাজে সুনামগঞ্জ পৌছানোর পর! এক যায়গায় গিয়ে দেখি সামনে আর রাস্তা নেই, যদিও গুগল ম্যাপে রাস্তা রয়েছে!! পরে জানতে পারি এটা তো হাওড় অঞ্চল, বর্ষাকালে এই রাস্তাগুলো ডুবে যায়। আমাদের শিক্ষা হয়ে যায় যে অন্ধভাবে কখনই গুগল ম্যাপ অনুসরণ করা উচিৎ না। হাহা!
যাহোক, আমরা নৌকায় বাইক উঠিয়ে অনেক ঝামেলা পোহানোর পর সেসব যায়গা অতিক্রম করে এক সময় সিলেট হাইওয়েতে উঠি। বিকেল নাগাদ অবশেষে সিলেট শহরে পৌছাই। সিলেট অনেক সুন্দর তবে কেন জানি মনে হল সিলেট শহরের রাস্তা সিএনজির দখলে রয়েছে। শহরে ঢুকতে কিছুটা জ্যামে পরতে হয়েছে। সিলেটে বিখ্যাত হোটেল হচ্ছে পাচভাই এবং পানসী। তবে এটা আমরা জানতে পারি আমাদের ট্রিপ শেষ! না জানা থাকায় র্যান্ডম একটি হোটেলে আমাদের দুপুরের খাবার খেয়ে নেই। এবং সিলেটের মানুষের ব্যাবহার অনেক ভাল লেগেছে আমাদের।
খাওয়া সেরেই বন্দরবাজারের দিক রওনা হয়ে হোটেল তাজমহলে একটি রুমের ব্যাবস্থা করি আমরা। বাইকের সিকিউরিটি নিয়ে কনসার্ন থাকায় আমরা বাজেট ফ্রেন্ডলি কিন্তু অপেক্ষাকৃত ভাল মানের হোটেলেই উঠি। রাতে শহরের বাজারে একটু ঘুরে বাকি ট্যুরমেটদের জন্য রেইনকোট নিয়ে নেই যাতে বাকি সময়ে বৃষ্টি আমাদের সমস্যা না করতে পারে। আজকে আর কোন ঘুরাঘুরি না, অনেক প্যারা গেছে তাই এখন দরকার বিশ্রাম।
তৃতীয় দিনঃ আজকে কাভার করব জাফলং এবং বিছানাকান্দি। প্রথম গন্তব্য হিসেবে নির্বাচিত করি আমরা জাফলং। সকালে নাস্তা খেয়েই দ্রুত রওনা দেই। দুপুরের আগেই আমরা সেখানে পৌছে যাই। তবে খুব আফসোস লাগে কিছু দুরের ঐ পাহাড়গুলো দেখে। সবগুলোই ভারতের দখলে! আমাদের বলতে কিছুই নাই বোধহয়। তবে রাস্তাগুলো অনেক বেশীই জোস!
জাফলং -এ আমার সব থেকে বেশী ভাল লেগেছে মায়াবী ঝর্ণা। এটাই মুলত আমার প্রথম ঝর্ণা দেখা তাই এক্সাইটমেন্ট অনেক বেশীই ছিল। তবে অতিরিক্ত এক্সাইটমেন্টে ঝর্ণার উপরের দিকে কেউ উঠতে যাবেন না। পাথরগুলো মুলত অনেক পিচ্ছিল থাকে, তাই সাবধানতা অবলম্বন করা বাঞ্চনীয়। জাফলং এবং মায়াবী ঝর্ণায় ভাল একটা সময় কাটানোর পর আমরা বিছানাকান্দির দিকে রওনা হই।
বিছানাকান্দিতে যেতে হয় নৌকাযোগে। নির্দিষ্ট যায়গা থেকে বেশ দারকষে একটি নৌকা ঠিক করে ফেলি আমরা। তার আগে সেখানকার একটি হোটেলে হাসের মাংস দিয়ে ভাল খেয়ে নেই পেট ভরে। খাবারের দামও বেশ কম ছিল। যাহোক বিছানাকান্দিতে এসে আশে পাশের পরিবেশ দেখে সন্তুষ্ট হয়েছি। তবে সামনের পাহাড়ের কাছেই ভারতের বর্ডার থাকায় খুব বেশী ভিতরে যেতে দেয়না। তবে এখান থেকে অসাধারণ ভিউ পাওয়া যায় যা মনের খোরক মেটাতে যথেষ্ট! বেশ অনেকখানি সময় কাটিয়ে আমরা পুনরায় সিলেটে আমাদের হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। এদিন আর তেমন কোন প্ল্যান নেই।
চতুর্থ দিনঃ আজকের প্ল্যান হচ্ছে রাতারগু, শাহজালালের মাজার এবং SUST ক্যাম্পাস ঘুরা। প্রথমেই রাতারগুলে উদ্দেশ্যে রওনা দেই সকালের নাস্তা সেরেই। বাইক থাকায় সবগুলোতেই জার্নি অনেকটা ফ্লেক্সিবেলভাবেই হচ্ছিল। কোথাও দেরি হলেও সমস্যা নাই আবার চাইলে তাড়াতাড়িও যেতে পারি ইচ্ছেমত। রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্টের ভিতরে দিকের মনোমুগ্ধকর পরিবেশে নৌকায় করে যেতে অসাধারণ একটি অনুভুতি হচ্ছিল। বর্ষাকাল ব্যাতীত এই যায়গায় পানি থাকেনা এবং এখানেই পানিই আসলে সৌন্দর্যবর্ধক হিসেবে কাজ করে। মুল আকর্ষণ এখানকার ওয়াচ টাওয়ার, সেখান থেকে পুরো এরিয়ার একটি অসাধারণ ভিউ পাওয়া যায়।
রাতারগুল থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে এবং দুপুরের খাবার খেয়ে রওনা হই শাহজালালের মাজারে দিক। অনেক মানুষ এখানে মানত করতে আসে, টাকা দান করে। একটি বড় কলসের মত পাত্রে মানুষ প্রচুর দান করতেছে দেখলাম, কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম কেন দিচ্ছেন? বলে সবাই দেয় তাই আমরাও দেই! আল্লাহ্ ব্যাতীত কেউ আপনার মনের ইচ্ছে পুরণ করতে পারবেনা অলৌকিকভাবে। এগুলো শিরকের পর্যায়ে যায়। রীতিমত মাজার কেন্দ্রিক ব্যাবসা গড়ে উঠেছে বলেই মনে হল।
এরপর SUST ক্যাম্পাসে গিয়েছি তবে ভিতরে ঢুকতে পারিনি কোভিড রেস্ট্রিকশনের কারণে!! সাত রং-এর চা খেতে ইচ্ছে হচ্ছিল তাই সময় থাকায় গেলাম চা খেতে। আহামরি ভাল লাগেনি তবুও চা প্রেমী হিসেবে টেস্ট করাই যায়, লসের কিছুনাই। হাহা। অতঃপর বাইরে আড্ডা দিয়ে সেদিনের মত সিলেট ট্যুরের পরিসমাপ্তি ঘটে!! এর মাঝে অবশ্য সিলেট স্টেডিয়ামেও গিয়েছিলাম সেদিন।
পঞ্চম দিনঃ খুব সকালে উঠেই বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেই তবে ট্যুরমেটদের সাজেশনের ভিত্তিতে কিশোরগঞ্জ পথিমধ্যে হওয়ায় নিকলি হাওড়ে ঢু মেরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই আমরা। হাইওয়ে ধরে কিশোরগঞ্জ পৌছাতে আমাদের প্রায় দুপুর বেজে যায় এবং খাবার পর্ব সেরে বাইক পার্ক করে নৌকাযোগে নিকলির উদ্দেশ্যে রওনা হই। খুব গরম ছিল তবে নিকলি পৌছানোর আগ মুহুর্তে শান্তির বৃষ্টি নামে, তবে খুব বেশীক্ষণ স্থায়ী হয়নি।
বৃষ্টির কারণে নিকলি হাওড়ের বুকে রংধনু দেখার সৌভাগ্য হয়। হাওড়ের মাঝে এই রাস্তায় যাওয়ার সময় কেমন যেন এক স্বর্গীয় এক অনুভূতি হচ্ছিল। বেশ এনজয়াবল ছিল সময়টা। অষ্টগ্রাম/মিঠামইন/রাস্ট্রপতি হামিদ সাহেবের বাসায় ঢু মেরে নৌকাযোগে সুর্যাস্ত দেখতে দেখতে পাড়ে ফিরতে সন্ধ্যা পার হয়ে যায়। রাত হয়ে যাওয়ায় আমরা কিশোরগঞ্জ শহরে একটি হোটেলে অবস্থান নেই। হোটেলটি বেশ এফোর্ডেবল ছিল এবং সব ধরণের সুযোগ সুবিধা ছিল।
ষষ্ঠ দিনঃ বাড়ি ফিরার দিন! খুব ভোরে উঠেই রওনা দেই আমরা বাসার উদ্দেশ্যে। দুপুরের নৌকা ধরতে হবে রৌমারিতে সেই উদ্দেশ্যে বেশ দ্রুত আসার চেষ্টা করি তেমন কোন বিশ্রাম না নিয়েই। তবে তাড়াহুড়া করতে আমাদের একটি ব্যাগ বাইক থেকে পরে যায়, মুলত রাস্তা খারাপ হওয়ায় ঝাকি খেয়ে। সেখানে দুইটা রেইনকোট, স্যান্ডেলসহ কিছু জিনিস ছিল। যাহোক দুঃখ করে লাভ নেই, আমরা বেশ অন-টাইমেই পৌছাতে সক্ষম হই। তবে পথিমধ্যে ট্যুরমেট মেহেদী ভাই বৃষ্টিতে ভিজে যান একদম বাজেভাবে। নৌকায় চেপে মোগলবাসা ঘাটের দিকে যেতে থাকি। উজানে নৌকা যেতে বেশ সময় লাগে, অনেক দেরীতে অবশেষে প্রায় বিকেল ৪ টা আমরা ঘাটে পৌছাই এবং ৬দিনের ১ হাজার কিলোমিটার বাইক রাইড তথা ট্যুরের সফলভাবে পরিসমাপ্তি ঘটে। খুব প্রি-প্লান্ড ট্যুর না হওয়া সত্ত্বেও বেশ উপভোগ্য ছিল পুরো সময়টা এবং সব ঠিকঠাকভাবেই হয়েছিল আলহামদুলিল্লাহ।
**ভ্রমণের ব্যাপ্তিকালঃ আগস্ট ২১ – ২৬, ২০২০